Sundarbans: এক গুলিতে রয়্যাল-হত্যা, তিন সন্তান হারিয়ে সেই জমিদার বাড়ির ছেলের পুঁজিতে কেবলই স্মৃতি – Bengali News | Sundarbans: The son of a zamindar house in Sundarbans is sad today
জমিদার বাড়ির ছেলে Image Credit source: TV9 Bangla
ক্যানিং: প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বুক দিয়ে বয়ে চলেছে দত্ত পশুর নদী। নদীর এক তীরে ঘন জঙ্গল। রয়্যাল বেঙ্গলের আস্তানা। অপর দিকে রয়েছে লোক বসতি গ্রামাঞ্চল। এই এলাকায় রয়েছে গোসাবা ব্লকের রজতজুবিলির ১৩ নম্বর অ্যানপুর গ্রাম। সেখানকার তৎকালীন জমিদার ছিলেন পরেশ মণ্ডল। আর এই বৃদ্ধ তাঁর বংশধর। জমিদার পরিবারের ছেলে। এখন অবশ্য দৃশ্যত তা বোঝা দায়। শীর্ণকায় চেহারা। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে দিন গুজরান করাই মস্ত চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সেই মানুষটিকে ঘিরেই হাজারও স্মৃতি।
সুন্দরবনে সে সময়ে শাসনে স্যার ডেনিয়্যাল হ্যামিলটন সাহেব। তিনি সুন্দরবনের মানুষের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন। যার ফলে সুন্দরবনের গোসাবার বিভিন্ন এলাকার জমিদারদের সঙ্গে সেসময়ে তাঁর সখ্যও গড়ে ওঠে। সালটা বাংলা ১৩৫৩। আজ থেকে প্রায় ৭৭ বছর আগে। শীতের মরশুম। মাঠের মধ্যে সোনালি ধানে ভরপুর।
আচমকা দত্তপশুর নদী সাঁতরে ১৩ নম্বর অ্যানপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। খবর চাউর হতেই গ্রামের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যায়। ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে পড়ে গ্রামের মানুষ। বাঘের হাত থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাবেন সেই চিন্তায় গ্রামের মোড়ল মাতব্বর-সহ সমস্ত গ্রামবাসীদের খাওয়া-দাওয়া-সহ রাতে ঘুম উবে যায়। ঘটনার কিছুদিন আগেই গ্রামের জমিদার পরেশ মণ্ডল একটি বন্দুক কিনেছিলেন জঙ্গলে হরিণ শিকার করার জন্য।
এই খবরটিও পড়ুন
গ্রামের সমস্ত মানুষজন পরেশ মণ্ডলের বাড়িতে হাজির হলেন। গ্রামবাসীদের দাবি করলেন যেন তেন প্রকারে বাঘের হাত থেকে গ্রামকে রক্ষা করতে হবে। বাঘের কবল থেকে গ্রামবাসীদের জীবন রক্ষা করার জন্য পরেশ মণ্ডলের নেতৃত্বে সুরেন্দ্র নাথ মণ্ডল, গণেশ চন্দ্র সরকার, অশ্বিনী কুমার মণ্ডল, ধীরেন্দ্র নাথ মণ্ডল, ক্ষেত্রমোহন সরকার, অশ্বিনী কুমার সরকার, দুর্গা মণ্ডলদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন।
বন্দুক আর ৭ সঙ্গীকে নিয়ে বাঘ শিকারে বেরিয়ে পড়েন। মাঠের ধান ক্ষেতে শুরু হয় বাঘে মানুষের লুকোচুরি খেলা। এমন ভাবে কয়েকদিন চলার পর ধান ক্ষেতে বাঘকে সামনে পেয়ে যান পরেশ ও তাঁর দলবল। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বন্দুক তাক করে পর পর তিনটি গুলি চালিয়ে দেন বাঘের শরীরে। কুপোকাৎ হয়ে পড়ে রয়্যাল বেঙ্গল। বন্দুকের গুলিতে বাঘ মারা পড়েছে জানতে পেরে গ্রামের লোকজন সেই সময় ভিড় জমিয়েছিল বাঘ দেখার জন্য।
আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন গ্রামবাসীরা। ধন্য ধন্য রব ওঠে পরেশ মণ্ডল ও তাঁর সঙ্গীদের নামে। বাঘ মারার পর মৃত বাঘ নিয়ে সোজা হাজির হন স্যার ডেনিয়্যাল হ্যামিলটন সাহেবের অফিসে। সেখানে মৃত বাঘকে সামনে রেখে স্যার ডেনিয়্যাল হ্যামিলটন সাহেবকে পাশে নিয়ে একের পর এক ছবি তোলেন পরেশ ও তাঁর সঙ্গীরা।
তৎকালীন সময়ে এমন বীরত্বের জন্য পরেশকে পাঁচ বিঘা জমি দিয়ে পুরষ্কৃত করেছিলেন হ্যামিলটন সাহেব। যা সুন্দরবনের বুকে এক বিরল ইতিহাস।
বাঘ শিকার দলের অন্যতম সদস্য সুরেন্দ্র নাথ মণ্ডলের বড় ছেলে প্রফুল্ল। প্রফুল্ল তৎকালীন সময়ে অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছিলেন। বাংলা বিষয়ের থেকে ইংরাজি বিষয়ে বেশ দক্ষতা অর্জন করলেও সরকারিভাবে কোনও কাজ না পেয়ে বাবার দেখানো পথ অবলম্বন করেন।
প্রফুল্ল মণ্ডলও একজন শিকারী হয়ে ওঠেন। সুন্দরবনের জঙ্গলে বেশ কয়েক বার বাঘের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তবে বাঘ শিকার করতে না পারলেও বাঘকে তাড়িয়ে গভীর জঙ্গলে ফেরত পাঠিয়েছেন প্রফুল্ল। ৮৩ বছরের বৃদ্ধ প্রফুল্ল’র তিন সন্তান প্রবীর, প্রশান্ত, প্রণব। বিভিন্ন রোগে তিন জনেরই মৃত্যু হয়েছে অকালে। বর্তমানে প্রফুল্ল, স্ত্রী বিশাখা, পুত্রবধু রূপা ও এক নাতিকে নিয়ে সংসার।
পুত্রশোকে জর্জরিত প্রফুল্ল বাবার সেই স্মৃতি জড়ানো ঘটনার ছবি বুকে করে আগলে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রফুল্ল’র কথায়, বাবা ও তাঁর সঙ্গীরা বাঘ মেরে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন,পুরষ্কার জুটেছিল। তিনি বলেন, “আমিও একজন দক্ষ শিকারী হতে চেয়েছিলাম। সেটা সম্ভব হয়নি। এরই মাঝে অকালে তিন সন্তানকে হারিয়েছি।দুঃখ শোকে পাথর হয়ে গিয়েছি।মাঝে মধ্যে সেই দুঃখ যন্ত্রণা ভুলতে বাবার স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছি।”
অন্যদিকে সুন্দরনের এই ১৩ নম্বর অ্যানপুরের পাথরপাড়ার পাশ থেকে অবিরাম বয়ে চলেছে দত্তপশুর নদী। বিভিন্ন সময়ে পর্যটকরা আসেন ভ্রমণ করতে। পর্যটকদের সঙ্গে দেখা হলেই সেই বাঘ শিকার গল্প শোনান প্রফুল্ল। কারণ একটাই বাবার কৃতিত্বের ছবি বুকে আঁকড়ে পুত্রশোকের কথা ভুলতে চাইছেন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপের প্রফুল্ল।