Mobile Addiction : রিল থেকে সেক্স, ‘প্রি-টিন’ খাঁচায় বন্দি শৈশব – psychologists say that smart phones have now taken over childhood all over the world
দক্ষিণ কলকাতার নামী বেসরকারি স্কুল। কথা নেই, বার্তা নেই ক্লাস টিচারকে হঠাৎ মিডল ফিঙ্গার দেখিয়ে বসল ক্লাস ফোরের ছাত্র। টিচার রেগে লাল! শাস্তিও দেওয়া হলো। কিন্তু যে প্রশ্ন আরও বড় ভাবে উঠে এল, শিখল কোথা থেকে! জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, সিনিয়র দাদাদের দেখেছে। তাই ভেবেছে স্মার্ট কিছু একটা হবে। অতএব ক্লাস টিচারকেই…
মুম্বইয়ের নামজাদা বেসরকারি স্কুলের বাঙালি পরিবারের ছাত্রী। ক্লাস থ্রি। বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে ৫০ টাকা চাওয়ার পরে বাবা-মায়ের সন্দেহ হয়। প্রথমে মুখ খুলবে না। চাপাচাপিতে শেষে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না— সহপাঠী ছাত্রটি ক্লাসে অন্য মেয়েদের গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। সে বলে পাঠিয়েছে, আইসক্রিম খেতে একশো টাকা দিলে ফ্রেন্ডশিপ করবে। দরাদরিতে সেটা পঞ্চাশে নেমেছে। অতএব বন্ধু পেতে…
কাল্পনিক নয়। ভারতের পূর্ব-পশ্চিম দু’প্রান্তে দুই স্কুলে দুই পড়ুয়ার এই কাণ্ড একেবারে বাস্তব। এ পর্যন্ত পড়ে যদি হতবাক হয়ে যান, তা হলে আরও বলা যাক— বাচ্চাদের এমন কাণ্ডে অবাক হওয়ার কিছু দেখছেন না মনোবিদরা। তাঁরা বলছেন, শৈশবেই যৌনচেতনার জন্ম এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার বিকাশ ব্যতিক্রমী তো নয়ই, বরং স্বাভাবিক। মনোবিদ থেকে শুরু করে পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট— বাচ্চাদের নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বক্তব্য, গোটা পৃথিবীতেই এখন শৈশবকে গ্রাস করেছে ‘প্রি-টিন সিনড্রোম’।
অর্থাৎ, টিন-এজ আসার অনেক আগেই টিনএজারদের মতো মানসিকতা এবং কাজকর্ম করছে শিশুরা। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে তাদের বেড়ে ওঠায়। মানসিক তো বটেই, এই প্রভাব বহু ক্ষেত্রে শারীরিকও। শৈশব আর কৈশোরের মধ্যে এক অদৃশ্য খাঁচায় বন্দি হচ্ছে বাচ্চারা। যেখানে তারা একইসঙ্গে ছোট, আবার বড়ও!
পশ্চিমে, বিশেষ করে আমেরিকা এবং ইউরোপের একটি অংশে ‘অ্যাডাল্ট-টিন’ কনসেপ্ট নতুন নয়। বিশেষ করে গত শতকের শেষ দিক থেকে দেখা যায় সেখানে টিনএজেই অ্যাডাল্টহুডের ছাপ পড়েছে বহু কিশোর-কিশোরীর মধ্যে। বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড থেকে ক্রমশ চুম্বন, এমনকী যৌনসম্পর্কও টিনএজের ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হয়ে দাঁড়ায়।
পরিবার ও সমাজের একটা অংশ তা মেনেও নেয়। যে ‘প্রি-টিন সিনড্রোম’ নিয়ে এখন এত আলোচনা এবং দুশ্চিন্তা, তাকে এই ‘অ্যাডাল্ট-টিন’-এরই অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ‘পাকা বাচ্চা’ কনসেপ্ট আগেও ছিল, এখনও আছে। ‘প্রি-টিন সিনড্রোমে’ শুধু ‘পাকামি’র সংজ্ঞাটা বদলে গিয়েছে। সেটা প্রকট হয়েছে কোভিডের সময় থেকে। অর্থাৎ, যখন অনলাইন ক্লাসের জন্য বাচ্চাদের মুঠোয় মুঠো-ফোন এসেছে।
মনোবিদরা বলছেন, বাচ্চাদের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার সময়ে রেসট্রিকশন বা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অধিকাংশ অভিভাবকই ভাবেননি। কারণ বাচ্চাদের স্মার্টনেসের তল পাননি তাঁরা। মোবাইলের কারিকুরি চোখের পলক ফেলার আগেই বুঝে নিয়েছে বাচ্চারা। আর অবাধ ইন্টারনেটের সুযোগে আনসেন্সরড কনটেন্টে চোখ গিয়েছে তাদের।
দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি স্কুলের ক্লাস ফোরের ক্লাস টিচারের অভিজ্ঞতা— ‘অনেক পেরেন্ট জানিয়েছেন, বাচ্চা অ্যাডাল্ট কনটেন্ট দেখেছে মোবাইলে। অনেক সময়ে ক্লাসেই দেখছি স্ল্যাং ব্যবহার করছে। এই সমস্যা কিন্তু আমরা ক্লাস থ্রি বা ফাইভেও পেয়েছি।’ মোবাইল ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা না হলে ‘পুশ নোটিফিকেশন’-এর মতো নানা পদ্ধতিতে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট স্ক্রিনে ভেসে আসে। স্বাভাবিক নিয়মেই এই ‘নতুন জিনিস’ আকর্ষণ করে বাচ্চাদের। জাগে নানা প্রশ্নও।
যার উত্তর বাবা-মায়ের কাছে চাইতে ভয় পায় বেশিরভাগ শিশু। উত্তরের সন্ধান চলে বন্ধুদের মধ্যে। আকর্ষণ ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসের মতো। মুম্বইয়ে কর্মরত পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পারমিতা সাহার ব্যাখ্যা, ‘কোভিডকালে হাতে মোবাইল তুলে দেওয়াটাই সমস্যার মূলে। তখন ছিল বাধ্যবাধকতা। বাচ্চারা বেরোতেও পারত না কোথাও। এন্টারটেনমেন্ট বলতে ছিল মোবাইলে বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিয়ো কল, বা ফোনে ভিডিয়ো দেখা। তখন বাধা দেওয়া হয়নি। তারই নানা কুফল ভুগতে হচ্ছে এখন।’
আর এক মনোবিদ চিত্রাঙ্কনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেটে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট তো বটেই, ম্যালঅ্যাডাপ্টিভ পিয়ার বিহেভিয়ারের মতো জিনিসও দেখা যাচ্ছে ছোটদের মধ্যে। অর্থাৎ, বিভিন্ন পরিস্থিতি বা স্ট্রেসকে সুস্থ ভাবে মোকাবিলার রাস্তায় বাধা আসছে।’ মনোবিদরা টিভির সিরিয়ালকেও দায়ী করছেন। তাঁদের বক্তব্য, কোভিডের সময়ে ঘরবন্দি অবস্থায় সিরিয়ালই ছিল অনেকের বন্দিদশার একমাত্র ‘মুক্ত বাতাস’। সে সব শিশুদের চোখে-কানে গিয়েছে। বলা বাহুল্য, সিরিয়ালের কনটেন্ট শিশুর পক্ষে ইতিবাচক কিছু নয়।
তা ছাড়া, বাচ্চাদের বিভিন্ন ভিডিয়ো বা রিল-এ সোশ্যাল মিডিয়া ছয়লাপ হয়েছে কোভিডের সময় থেকেই। লকডাউনে ঘরবন্দি বাচ্চাকে দিয়ে ফিল্মের ডায়লগে লিপ সিঙ্ক করানো থেকে শুরু করে নাচ, গান, আবৃত্তি— সোশ্যাল মিডিয়া তখন যেন পাড়ার ফাংশনের স্টেজ! এই সব রিল বা ভিডিয়োয় গুচ্ছ গুচ্ছ লাইক আর কমেন্টও শৈশবে টেনে এনেছে কৈশোরের ছায়া। ‘আমারও লাইক চাই, কমেন্টস চাই’, অন্যকে দেখে এই যে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, যা সাধারণত টিনএজে আসে, তা চলে আসছে প্রি-টিনএজেই।
মনোবিদ শর্মিলা সরকার বলছেন, ‘বাচ্চারা রিওয়ার্ড-পানিশমেন্ট প্রসেসের মধ্যে দিয়ে বড় হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় কাউকে রিওয়ার্ডেড হতে দেখে তীব্র ইচ্ছা তৈরি হয় সে সব পাওয়ার। অনুকরণের পথে এগোয় সে। ‘প্রি-টিন সিম্পটম’-এর যা একটি বড় উপসর্গ।’ শর্মিলা সতর্ক করছেন, ‘বাচ্চা মোবাইলের লক খুলে ফেলছে, ইন্টারনেট সার্চ করছে, রিল বা ভিডিয়ো বানাচ্ছে দেখে বাবা-মা বা পরিবারের লোক খুশি হন। লাইক, কমেন্টের বন্যা বইলে তো কথাই নেই। সর্বনাশের বীজ এখানেই পোঁতা হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চার তারিফ করুন, কিন্তু কেন করছেন, সেটা তো বুঝতে হবে।’
রয়েছে শারীরিক প্রভাবও। শর্মিলা এবং পারমিতা দু’জনেই বলছেন, বাচ্চাদের পিউবার্টি (বয়ঃসন্ধি) এগিয়ে এসেছে। কারণ মনের সঙ্গে হরমোন-প্যাটার্নেও পরিবর্তন আসছে। প্রভাব পড়ছে চোখেও। এক চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘অতিরিক্ত মোবাইল দেখার ফলে এখন ঘরে ঘরে বাচ্চাদের ড্রাই আই দেখা দিচ্ছে। অবিলম্বে স্ক্রিন টাইম না কমালে চোখের বড় সমস্যায় ভুগবে এরা সকলে।’
তা হলে সমাধান কী? চিত্রাঙ্কনা বলছেন, ‘তারা যা শিখছে, যা দেখছে— বাচ্চারা যাতে এসে সব শেয়ার করতে পারে, তেমন একটা ভয়হীন পরিবেশ তৈরি করা উচিত বাবা-মা বা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। অনেক সময়ে বাচ্চারা বকাঝকার ভয়ে অনেক কিছু লুকিয়ে যায়। ওই সেফ স্পেস তৈরি করলেই একমাত্র সমস্যাটা সঠিক ভাবে বোঝা যাবে। তবেই সুস্থ সমাধান সম্ভব। কেন বাচ্চা এমন ব্যবহার করছে, সেটা সঠিক ভাবে আইডেন্টিফাই না করে তাকে সবক শেখাতে ঝাঁপিয়ে পড়াটা ভুল হবে।’